মুসলিম ফুটবলারে বদলে যাওয়া প্রিমিয়ার লীগ!
আধুনিক বিশ্ব ফুটবলে যতগুলো ঘরোয়া লিগ চালু আছে তার মধ্যে দর্শকপ্রিয়তা, টেলিভিশন স্বত্ত্ব ও আর্থিক মূল্যমানের দিক দিয়ে সবার উপরে আছে ‘ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বা ইপিএল’। ইপিএলে একটা সময় মুসলিম খেলোয়াড়দের প্রতিনিধিত্ব ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমান সময়ের ইপিএলের চেহারর ও সংস্কৃতিই পাল্টে দিচ্ছেন মুসলিম ফুটবলাররা।
১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া লিগ যখন ‘ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ’ নামে শুরু হয়েছিল তখন প্রিমিয়ার লিগে খেলা মুসলিম খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল মাত্র একজন। টটেনহ্যাম হটস্পার্সের হয়ে খেলতেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার নাঈম। তবে এখন সেই সংখ্যা অনেকগুন বেড়েছে। বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগের বিভিন্ন ক্লাবে খেলা মুসলিম খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৫৮ জন। এই মুসলিম খেলোয়াড়ই নিগুরে পাল্টে দিচ্ছেন ইপিএলের সংস্কৃতি। মুসলিম খেলোয়াড়রা বেশ কিছুদিন আগে থেকে খেলে আসলেও তাদের গোল উৎযাপন ছিল একেক রকম।
তবে প্রিমিয়ার লিগের সংস্কৃতি পাল্টে দেয়া ঘটনা ঘটে ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। সেন্ট জেমস পার্কে চলছিল নিউক্যাসল ইউনাইটেড বনাম অ্যাস্টন ভিলার ম্যাচ। ওই ম্যাচের একটি গোল উৎযাপনের ভঙ্গিই হয়ে ওঠে প্রিমিয়ার লিগে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতীক। খেলার ৩০ মিনিটের মাথায় ইউনাইটেডের হয়ে গোল করেন সেনেগালের মুসলিম খেলোয়াড় ডেম্বা বা। তিনি গোল উৎযাপনের জন্য দৌড়ে চলে যান কর্নার পতাকার কাছে। যেখানে দাড়িয়েছিলেন তার স্বদেশী আরেক খেলোয়াড় পাপিস সিসে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুই সতীর্থ গোল উৎযাপনের জন্য সিজদায় পড়ে যান।
সেই থেকে ওই সিজদাই হয়ে ওঠে প্রিমিয়ার লিগে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতীক। লিগে খেলা প্রত্যেক মুসলিম খেলোয়াড়ই এখন ওই প্রতীক ব্যবহার করছেন। শুধু প্রিমিয়ার লিগেই নয়, মুসলিম সংস্কৃতির ওই প্রতীককে মুসলিম খেলোয়াড়রা এখন আন্তর্জাতিককরণ করে ফেলেছেন।
প্রিমিয়ার লীগে খেলুড়ে মুসলিম ফুটবলারদের সংখ্যা এখন ৫৮ জন। যার মধ্যে ৯ জন ট্রাইকার, ৩৪ জন মিডফিল্ডার এবং একজন গোলকিপার। প্রিমিয়ারলীগে সর্বোচ্চ ৫ জন করে মুসলিম ফুটবলার আছেন ৩টি ক্লাবে। ক্লাবগুলো হচ্চে- আর্সেনাল, ম্যাঞ্চেষ্টার সিটি এবং স্টোকসিটি এফসি। উল্লেখ্য, গত সিজনে ইংলিশ ক্লাব ওয়ার্টফোর্ডের মুসলিম খেলোয়াড় সংখ্যা ছিলো ৬ জন!
গোল দেয়ার পর সেজদায় মোহাম্মদ সালাহ ও সাদিও মানে। |
জার্মানির মেসুত ওজিল- মোস্তাফি কিংবা এমরে চান, ফ্রান্সের কান্তে- সাগনা- মামাদো সাকো- পগবা- সিসোকো কাবুল, বসনিয়ার আসমির বেগোবিচ, মিশরের মোহাম্মদ সালাহ, সুইজারল্যান্ডের জর্ডান শাকিরি কিংবা সেনেগালের সাদিও মানে, ঘানার আন্দ্রে আইয়ো- এই ফুটবলাররা বিশ্বফুটবলের একটি শাখা ইপিএলে নিজেদেরকে প্রমাণের পাশাপাশি মুসলিম ফুটবলারদের প্রতিনিধিত্ব এবং প্রতিভারও প্রমাণ দিচ্ছেন তা বলাই বাহুল্য।
এবার বলবো বর্তমানে প্রিমিয়ার লীগ খেলুড়ে সবচেয়ে দামী দশ ফুটবলারদের কথা। প্রিমিয়ারলীগের সবচেয়ে দামি মুসলিম ফুটবলার হলের ফান্স ও ম্যাঞ্চেষ্টার ইউনাইটেড তারকা মিডফিল্ডার পল লেইভে পগবা। ৮৯ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে জুভেন্টাস থেকে তাকে দলে বেড়ায় রেড ডেবিলরা। অত:পর তালিকায় আছেন লিভারপুলের ফুটবলার সেনেগাল জাতীয় দলের স্ট্রাইকার সাদিও মানে, যার বাজারদর ৩৫ মিলিয়ন। এরপরে আছেন জার্মান ফুটবলার মোস্তাফি, তার মূল্যেও ৩৫ মিলিয়ন। গ্র্যানিট যাকা এবং কান্তে'র মূল্যে ৩০ মিলিয়ন। লিস্টার সিটির রেকর্ড সাইনিং ইসলাম স্লিমানি আছেন এরপরেই, যার মূল্যে ২৯ মিলিয়ন। আর্সেনালের গুন্ডগান এর বাজারদর ২৩ মিলিয়ন। আদ্রে আইয়ো পেলে ২০ মিলিয়ন এবং সাউদ্যাম্পটনের রেকর্ড সাইনিং সোফিয়ান বাউফল এর মূল্যে ১৬ মিলিয়ন। সর্বশেষে আছেন আহমেদ মুসা, লিস্টারসিটির আরেক রেকর্ড সাইনিং প্লেয়ার। শুধুমাত্র এই ১০ জন ফুটবলারের বাজারমূল্য ৩২২ মিলিয়ন ডলার!
পবিত্র ঈদ উদযাপন করছেন পল পগবা। |
ইউরোপের বিভিন্ন লিগে প্রায় দেড় শতাধিক মুসলিম খেলোয়াড় বিভিন্ন ক্লাবে হয়ে খেলছেন। ফুটবল বিশ্ব নতুন প্রতিভা খুঁজতে যে জাল ফেলেছে। তার মধ্যে ইংলিশি প্রিমিয়ার লিগে জালটাই বোধ হয় বেশি শক্ত। আফ্রিকার মতো অনগ্রসর মহাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণরাও প্রিমিয়ার লিগে এসে হয়ে উঠছে মহারতারকা। তবে অনগ্রসর আফিকানদের তারকা হওয়ার আরেকটি জায়গা প্যারিসও।
ইংলিশ ক্লাবে খেলে তারা অনেক অর্থ এবং খ্যাতি পায়। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখার সর্বাত্নক চেষ্টা করে। কারণ যে সংস্কৃতি তাদের পথ দেখায়, স্বস্তি এবং শক্তি দেয় তা হলো তাদের ইসলামিক বিশ্বাস। ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে ক্লাব পরিবর্তনের সময় অনেক খেলোয়াড়ই তাদের ধর্মের জায়গাটা পরিস্কার করেন।
যেমন ডেম্বা বা, তিনি গত বছর নিউক্যাসল ছেড়ে চেলসিতে যোগ দিয়েছেন। ক্লাব পরিবর্তনের সময় বা চেলসিকে বলেছিলেন, আমি আমার ধর্মের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। ক্লাব তার সে কথা মেনে নিয়ে তাকে ধর্মর স্বাধীনতা দিয়ে দলে নিয়েছে তাকে। মুসলিম খেলোয়াড় দাবি মতোই প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো তাদের মুসলিম খেলোয়াড়দের জন্য হালাল খাবারের ব্যবস্থা করে, দলের অন্য খেলোয়াড়দের কাছ থেকে আলাদা থাকার ব্যবস্থা, ভিন্ন গোসলখানা ও প্রার্থনার জন্য তাদেরকে সময় সুযোগ করে দেয়।
ইংলিশ ফুটবলের রীতি বদলে দিতে এটাই বা কম কিসে? জয় হউক মুসলিম ফুটবলারদের, জয় হউক বিশ্বফুটবলের।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
No comments