১৯৩০ বিশ্বকাপ এবং নতুন এক অধ্যায়ের সৃষ্টি।
ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই ফুটবল খেলুড়ে সেরা সেরা দলগুলোর তুমুল লড়াই। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেরা পার্ফম করে বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলে কোনো দেশ। আচ্চা, এই ফুটবল বিশ্বকাপ কিভাবে শুরু হলো? ফুটবল ফ্যানদের এমন প্রশ্ন তো থাকতেই পারে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ফুটবল তখনও অঞ্চলভেদেই জনপ্রিয়। ফুটবলের অভিভাবক ফিফার জন্মও (১৯০৪) বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই। হয়তো তাদের পরিকল্পনা ছিলফুটবলকে আঞ্চলিকতার সীমানা ভেঙ্গে বৈশ্বিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতার মাঝে আনা।আর সেই পরিকল্পনার মূল উৎস ছিল অলিম্পিক গেমসে ফুটবলের সাফল্য। তখনই ফুটবল অভিভাবক গোত্রের ইচ্ছে জাগে, এই খেলায় নিজেদের আলাদা একটিপ্রতিযোগিতা কেন আয়োজন করা হচ্ছে না?
যেই ভাবা সেই কাজ। বহু স্বপ্ন নিয়ে ফিফার সদস্য দেশগুলোকে প্রস্তাব পাঠানো হয়। জানতে চাওয়া হয় তাদের ভাবনা কি এবং কি কি শর্তে এই টুর্নামেন্টকে আলোর মুখ দেখানো সম্ভব। তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের তত্ত্বাবধানে একদল কমিটি এসকল বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করে।
১৯২৮ সালের ২৮ মে, আমস্টারডামে ফিফার একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফিফার সেই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ফুটবলের নতুন একটি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হবে। সেই টুর্নামেন্টে ফিফা সদস্য সকল দলের অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়। আয়োজন করা যখন নিশ্চিত হল তখন আয়োজক দেশ কারা হতে যাচ্ছে এটি নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়।
হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও সুইডেন তাদের পছন্দসই দেশের নাম জমা দেয়। তবে শুরু থেকেই সবচেয়ে বেশি যে দেশকে ফেভারিটের তালিকায় রাখা হয়েছিল সে দেশটি হল উরুগুয়ে! ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালের অলিম্পিক গোল্ড মেডেল জয়ী উরুগুয়ে শুধুমাত্র তৎকালীন ফুটবল পরাশক্তি হিসেবেই দাবীদার ছিল তা নয় । দেশটির স্বাধীনতার শত বছর পূর্তি উপলক্ষে সেখানে উৎসবের আমেজ। আর উৎসবের দেশে খেলাটির সবচেয়ে উন্মাদ সমর্থকদের মাঝে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন করা যুক্তিসংগতও ছিল বটে।
সিদ্ধান্তটি জানানোর এক বছর পর বার্সেলোনার আরেকটি সভায় সবাই একমতে পৌঁছান যে, তৎকালীন ফুটবলের সুপার পাওয়ার অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে তাদের স্বাধীনতার শতবছর পূর্তি উপলক্ষে ফুটবলবিশ্বকাপের প্রথম আসরটি আয়োজন করবে। তবে সেই শতবছর পূর্তির উদযাপন যে তারা বিশ্বকাপ জিতেই করবে তা কি কারো জানা ছিল?
দক্ষিণ আমেরিকা আয়োজক দেশ হওয়ার সিদ্ধান্তটি ইউরোপের অনেক দেশ সহজে মেনে নিতে পারেনি। অবশ্যই ইউরোপজুড়ে তখন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনেক দেশই অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নেয়। শুধুমাত্র সমুদ্রস্থলে পাড়ি দিয়ে উরুগুয়ে পৌঁছানোই নয়, ক্লাবগুলো দুই মাসের জন্যে তাদের খেলোয়াড়দের ছাড়তে অস্বীকৃতি জানানোও ছিল প্রধান বাঁধা! ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলস ছিল এই আসরের জন্যে অনুপুযুক্ত। অপেশাদার খেলোয়াড়দের বেশি বেতন দেয়ার কারণে তারা ফিফা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। তবে ব্রিটিশ কিছু খেলোয়াড় ঠিকই বিশ্বকাপ খেলার রাস্তা খুঁজে নেয়, আমেরিকার হয়ে তারা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে।
ইউরোপ থেকে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা চারটি দেশ ছিল বেলজিয়াম, ফ্রান্স, যুগোস্লাভিয়া এবং রোমানিয়া। বাকি যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। ইউরোপে অনুষ্ঠিত হবে না টুর্নামেন্ট তা মেনে নিতে পারেনি অনেক দেশ, আবার অন্য কিছু দেশের পক্ষে সাউথ আমেরিকার কোনো দেশে তিন সপ্তাহ অবস্থান করা ছিল নিষেধাজ্ঞাস্বরূপ।
রোমানিয়া সুযোগ পেয়েছিল কারণ তৎকালীন রাজা নিজে দলটির স্কোয়াড ঠিক করবেন এই শর্ত মেনে নেয়া হয়েছিল। তিনি খেলোয়াড়দের তিন মাসের ছুটি দিয়েছিলেন এবং নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের পর তারা দেশে ফিরে এলে তাদের আবারো কাজের সুযোগ দেয়া হবে।শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৩টি দেশ বিশ্বকাপের প্রথম আসরে অংশগ্রহণ করে, যেখানে সাতটি দেশই ছিল দক্ষিণ আমিরকার। অপর ৬টি দেশের দুটি উত্তর আমেরিকার ও অন্য চারটি দেশ ছিল ইউরোপের।
ইউরোপের মাত্র চারটি দেশ রাজি হওয়ায় আয়োজক কমিটি অসম্ভব হতাশ ছিল। তবে উরুগুয়েকে আয়োজক দেশ হওয়ার কারণে ফিফার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়। আর এরই মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিশ্ব ফুটবলের নতুন আঙ্গিকে পথচলা।১৩টি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়।
১ম গ্রুপে ছিল – আর্জেন্টিনা, চিলি, ফ্রান্স ও মেক্সিকো।
২য় গ্রুপে ছিল – যুগোস্লাভিয়া,ব্রাজিল ও বলিভিয়া।
৩য় গ্রুপে ছিল – উরুগুয়ে, রোমানিয়া ও পেরু এবং
৪র্থ গ্রুপে ছিল –যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম এবং প্যারাগুয়ে।
বিশ্বকাপের সব ম্যাচই অনুষ্ঠিত হয়েছিল মন্তেভিদেও শহরের তিনটি স্টেডিয়ামে –এস্তাদিও সেন্তেনারিও যার দর্শক ধারণ ক্ষমতা ছিল ৯০ হাজার, এস্তাদিও গ্রান পার্কে সেন্ত্রাল যার ধারণ ক্ষমতা ছিল ২০ হাজার, এস্তাদিও পোহিতস যার ধারণ ক্ষমতা ছিল ১ হাজার। আর প্রত্যাশা অনুযায়ী দক্ষিণ আমেরিকান দলগুলোই টুর্নামেন্টে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। যদিও ইউরোপিয়ান দলগুলোও একেবারে খারাপ করেনি।লুসিয়েন লরেন্ত বিশ্বকাপের প্রথম গোল করার গৌরব অর্জন করেন, এবং তাঁর হাত ধরে ফ্রান্সও বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোকে ৪-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে প্রথম জয়ের গৌরব অর্জন করে। তবে তারা দূর্ভাগ্যজনকভাবে এক নাটকীয় ম্যাচে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ১-০ গোলে পরাজিত হয়। রেফারী ভুলক্রমে খেলা শেষ হওয়ার ৬ মিনিট আগেই বাঁশি বাজিয়ে ম্যাচের ইতি টানেন। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারেন যে আসলেই তিনি ভুল করেছেন। তিনি তখন খেলোয়াড়দের মাঠে ফিরে আসতে বলেন, যখন কিনা অনেক খেলোয়াড়ই ম্যাচ শেষ হওয়ায় স্নানে ব্যস্ত ছিল!
বিশ্বকাপের দুটি সেমিফাইনালই ছিল একপেশে। যুক্তরাষ্ট্র, যারা গ্রুপ পর্বে বেলজিয়াম এবং প্যারাগুয়েকে হারিয়ে সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয়। আর্জেন্টাইনরা ফ্রান্সের বিপক্ষে কষ্টার্জিত জয়ের পরে চিলি ও মেক্সিকোকে সহজেই হারিয়েছিল । সেমিফাইনালের মধ্যবিরতিতে আর্জেন্টাইনরা ১-০ গোলে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু বিরতির পর শুরু হওয়ার পরেই যেন যুক্তরাষ্ট্র রক্ষণভাগে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা। একে একে ছয় গোল দিয়ে ৬-১ গোলের বিশাল জয় আদায় করে নেয় এবং এরই সাথে ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ফাইনালে জায়গা করে নেয়। অন্য সেমিফাইনালেও দেখা যায় প্রায় একই চিত্র, মাত্র চার মিনিটেই যুগোস্লাভিয়ার গোলে পিছিয়ে পড়ে উরুগুয়ে। কিন্তু পরে ফিরে আসে ঠিকই।
প্রথম সেমিফাইনালের স্কোরলাইনের আবারো পুনরাবৃত্তি ঘটায় উরুগুয়ে। ফলাফল উরুগুয়ে বনাম আর্জেন্টিনা ফাইনাল। আর এই ফাইনাল ছিল আর্জেন্টাইনদের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ। ১৯২৮ সালের অলিম্পিক ফুটবলের ফাইনালে এই উরুগুয়ের কাছেই ২-১ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। ৩০ জুলাইয়ের ফাইনাল উপলক্ষে সেন্তেনারিও স্টেডিয়ামে প্রায় লাখ খানেক দর্শক ভিড় জমায়। মধ্যবিরতিতে আর্জেন্টাইনরা ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল, কিন্তু বিরতির পর দুর্দমনীয় উরুগুয়ে ৪-২ গোলের এক অবিস্মরণীয় জয় পায়। মজার তথ্য হচ্ছে এই ফাইনালের প্রথমার্ধে আর্জেন্টাইন এবং দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুইয়ান ফুটবল ব্যবহৃত হয়েছিল।বিশ্বকাপের স্বপ্নদ্রষ্টা ও ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে বিশ্বকাপের ট্রফি উরুগুইয়ান অধিনায়ক হোসে নাসাসির হাতে তুলে দেন এবং এরই সাথেফুটবলবিশ্বের সবচেয়ে বড় আসরের জন্ম হয়।
একনজরে পরিসংখ্যানে ১৯৩০ বিশ্বকাপঃ
★দল: ১৩টি
★সময়কাল: ১৩ই জুলাই ১৯৩০-৩০ জুলাই ১৯৩০
★ফাইনাল: ৩০ জুলাই ১৯৩০
★ম্যাচ সংখ্যা: ১৮টি
★মোট গোল: ৭০টি (গড়ে ৩.৯টি করে গোল হয়ে প্রতি ম্যাচে)
★মোট দর্শক উপস্থিতি: ৫৯০৫৪৯ জন (গড়ে৩২৮০৮ জন করে প্রতি ম্যাচে)
★সর্বোচ্চ গোলদাতা: ৮টি – গিয়ের্মো স্তাবিলে (আর্জেন্টিনা)
সেই থেকেই শুরু হয়েছিলো বিশ্বকাপের পথচলা। প্রতি চার বছর পরপর অনুষ্টিত হতে আসছে এটি। বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়তার কারনে ফুটবল বিশ্বকাপ এখনো ঠিকে আছে। মুলত ১৯৩০ সালের সেই বিশ্বকাপ ই ছিলো ইতিহাস রচনার মুল প্লাটফর্ম।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
No comments